অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অসত্য

‘ব্যাংকে চুরিচামারি, জালিয়াতি হয়, অন্য দেশেও হয়’- প্রস্তাবিত বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এমন মন্তব্য সত্য নয় বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের মতো ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা বিশ্বের কোনো দেশে হচ্ছে না। আর অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য মোটেই সঠিক নয়। এটি প্রমাণে প্রয়োজনে তিনি (অর্থমন্ত্রী) নিজেও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দেখতে পারেন। পাশাপাশি ‘ব্যাংক লুটেরাদের’ বিচার না করে উল্টো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে ভর্তুকি দেয়ার প্রস্তাবকে বড় ধরনের অন্যায় হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি উৎসাহিত হচ্ছে ব্যাংকিং খাতের দুর্বৃত্তরা। সুশাসনের অভাবেই জনগণের করের টাকা এভাবে গচ্চা দেয়া হচ্ছে বলেও মন্তব্য তাদের। এছাড়া শুক্রবার ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, এক লাখ টাকার আমানতকারীরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্পদশালী। তারাও বর্ধিত আবগারি শুল্ক বহন করতে পারবেন। তার দেয়া এই বক্তব্যও মানতে নারাজ অর্থনীতিবিদরা। এই অঙ্কের মালিকদের সম্পদশালী বলাটা একটি অদ্ভুত বিষয় বলে মন্তব্য করে শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি করেন তারা। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের ঋণ আদায় এবং দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করছে।
ফলে ব্যাংকগুলোতে ঘন ঘন মূলধন ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারও জনগণের করের টাকায় সেই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছে। সুশাসনের প্রবল ঘাটতির কারণেই এসব হচ্ছে। সরকারি ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক বাণিজ্যের প্রভাব থেকে মুক্ত করা না গেলে জনগণের করের টাকা এভাবেই গচ্চা যাবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। প্রসঙ্গত, এই মুহূর্তে সরকারি ছয় ব্যাংক ও বেসরকারি একটি ব্যাংকে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৬ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি পূরণে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই পুরো অর্থ ব্যয় হবে জনগণের করের অর্থ থেকে। অথচ ব্যাংকগুলোর অধিকাংশ মূলধন সংকট হয়েছে দুর্নীতি ও ঋণ জালিয়াতির কারণে। শুধু বেসিক ব্যাংকে অনিয়মের মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। আর হলমার্ক কেলেংকারিতে সোনালী ব্যাংকের তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের এই লুটপাটের প্রধান হোতা শেখ আবদুল হাই বাচ্চু এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। জানা গেছে, বর্তমান সোনালী ব্যাংকের মূলধন ২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) ৭৩৭ কোটি টাকা, কৃষি ব্যাংকের ৭ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৭০৫ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মতে, লুটপাটের মাধ্যমে বেসিক ব্যাংকের মূলধন বস্তায় ভর্তি করে ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া হয়। ঋণের নামে এই টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। একই ঘটনা হলমার্কের দুর্নীতির কারণে সোনালী ব্যাংক ঘাটতির মুখে পড়ে। অন্যান্য ব্যাংকের মূলধন ঋণের নামে বের করে নেয়া হয়। ফলে সব মিলে ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি কেন হচ্ছে এবং এর জন্য কারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো জনগণের করের টাকায় সেই ঘাটতি মেটানো হচ্ছে। অথচ তিনি (অর্থমন্ত্রী) বলছেন, বিশ্বের সব দেশেই চুরিচামারি হয়। এটা কোন ধরনের সংস্কৃতি।
কার টাকা তিনি অপচয় করছেন? একদিকে অপচয় করা হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে না। আবার বলা হবে সব দেশেই এটা হচ্ছে। একজন অর্থমন্ত্রীর মুখ থেকে আমরা এতটা আশা করিনি। তিনি বলেন, বিশ্বের কোনো দেশেই বাংলাদেশের মতো এত বিশাল আকারের ব্যাংক দুর্নীতি হয় না। যেসব দেশে হয়েছে, সেখানে দুর্নীতির পরিমাণ খুবই কম। তদুপরি সব দেশেই অপরাধের পরিধি অনুযায়ী দায়ীদের শাস্তিও হয়েছে। হয়নি শুধু বাংলাদেশেই। এটা বলছেন না কেন অর্থমন্ত্রী- এ প্রশ্ন রাখেন সাবেক এই গভর্নর। এক লাখ টাকা সম্পদের ওপর বর্ধিত আবগারি শুল্ক আরোপ প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গরিবের সম্পদ হচ্ছে কিছু নগদ টাকা। সেটি বড়জোর ১ লাখ থেকে তিন-চার লাখ টাকা হতে পারে। এটা গরিবের তিলে তিলে সঞ্চয়, বোনাস কিংবা বাড়তি কষ্টের ফসল। বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় এটা খুবই কম। ফলে তিনি ওই অর্থ দিয়ে কোনো সম্পদ কিনতে পারেন না। এ অর্থের সঙ্গে বাড়তি কিছু পাওয়ার আশায় তারা ওই অর্থ ব্যাংকে রাখেন। এর জন্য ওই টাকার মালিককে যথেষ্ট সম্পদশালী বলাটা একটা অদ্ভুত বিষয়। অবাক লাগে কী করে এসব কথাবার্তা তিনি বলেন। ব্যাংকিং খাতে ‘চুরিচামারি, জালিয়াতি হয়, অন্য দেশেও হয়’- অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য সত্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। শনিবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমরা আশ্চর্য হই একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে অর্থমন্ত্রী কিভাবে এ কথা বলেন। তিনি (অর্থমন্ত্রী) প্রয়োজনে এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দেখতে পারেন। কারণ বাংলাদেশের মতো ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা বিশ্বের আর কোথাও হয় না। তবে কোথাও থাকলেও সেটা হচ্ছে মন্দ বা খেলাপি ঋণ। তাও বড়জোর এক থেকে দু’শতাংশের মধ্যে। অথচ আমাদের ব্যাংকিং সিস্টেমে একটা বড় অংশই হচ্ছে মন্দ এবং খেলাপি ঋণ। তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংকে লুটপাট হয়েছে। এখনও এর ৬০ শতাংশের বেশি মন্দ ঋণ। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) ক্ষেত্রেও মন্দ ঋণের হার একই। বলতে দ্বিধা নেই, ব্যাংকিং খাতে লুটতরাজ হচ্ছে। আমরা খুশি হতাম, যদি অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে এই লুটতরাজ বন্ধে জাতিকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কথা শোনাতেন। সেটা না করে যা বলেছেন, সত্যিই দুঃখজনক।
এভাবে ব্যাংকগুলো চলতে থাকলে এবং দায়িত্বশীলরা তাদের সাফাই গেয়ে বক্তব্য দিলে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে যাবে। এদিকে করের টাকায় ব্যাংকের ঘাটতি মূলধন পূরণের তীব্র সমালোচনা করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। শুক্রবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রস্তাবিত বাজেটের খারাপের দিক হচ্ছে- ব্যাংক লুটেরাদের বিচার না করে উল্টো এ খাতে ভর্তুকি দেয়ার প্রস্তাব। এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। বাজেট থেকে এ ধরনের সহায়তা ন্যায়বিচার পরিপন্থী। সরকারি ব্যাংক লুটপাট হয়ে যাচ্ছে, আর এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার না করে বাজেট থেকে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে, এর চেয়ে বড় অন্যায় আর হতে পারে না। অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার দিন বৃহস্পতিবার থেকে গ্যাসের দাম বেড়েছে। বাজেট ঘোষণার সময় নিন্মআয়ের মানুষের খাদ্য মোটা চালের বাজারে বিরাজ করছে ঊর্ধ্বমুখী দাম। একই সঙ্গে সাধারণ আমানতকারীদের ওপর আবগারি শুল্ক হার বাড়িয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট হার বাস্তবায়ন করা হবে পহেলা জুলাই থেকে। যা প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর ফলে বাড়বে জিনিসপত্রের দাম। জনগণের ওপর এসব চাপিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠতম বাজেট দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী। যা বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই বলে মন্তব্য তাদের (অর্থনীতিবিদ)। প্রস্তাবিত বাজেটে এক লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক লেনদেনের আবগারি শুল্ক ৫শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮শ’ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেনের জন্য দেড় হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা, এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেনে সাড়ে সাত হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা এবং পাঁচ কোটি টাকার বেশি ব্যাংক লেনদেনে আবগারি শুল্ক ১৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
Share on Google Plus

About Unknown

    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment