ভারতে গরু জবাই বিতর্ক

কেন্দ্রীয় সরকারের গবাদিপশুর বাজার নিয়ন্ত্রণবিষয়ক ‘প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমলস’-এর আলোকে নতুন নীতিমালা গত কয়েক দিন ধরে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা তৈরি করেছে। জবাইয়ের জন্য পশুর বাজারগুলোতে গরু ও মহিষ বিক্রি কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ করা এবং ফলস্বরূপ পরোক্ষভাবে গরুর মাংস বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের এসব নীতিমালা কেরালা ও তামিলনাড়– রাজ্যে প্রতিবাদের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে; একইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র নিন্দা কুড়িয়েছে। মঙ্গলবার মাদ্রাজ হাইকোর্ট গরুকেন্দ্রিক এসব নীতিমালার বিরুদ্ধে চার সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন, দ্রুতই লড়াই আদালতে গড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক গোলযোগ ছাড়াও আইনি এবং সাংবিধানিক খুঁত-ত্রুটির পথও আবারও খোলা হয়ে গেল- যা কী ফল বয়ে আনবে তা নিয়ে অনেক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ সমস্যার একটা ইতিহাস আছে যা দেশ ও গণপ্রজাতন্ত্র গঠনের সময় থেকে শুরু হয়েছে। সংবিধান প্রণয়নের সময় গরু জবাইয়ের বিষয়টা ছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও বিতর্কিত একটা ইস্যু। সাংবিধানিক পরিষদের সদস্য সেঠ গোবিন্দ দাস বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘লর্ড কৃষ্ণের সময় থেকেই এটা একটা সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত এবং গরু জবাইকে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অধ্যায়ে নিষিদ্ধ হিসেবে অন্তর্ভুক্তের আহ্বান জানান তিনি। তার এ অবস্থানকে অনেক সদস্যই সমর্থন করেছিলেন। গরু জবাই নিষিদ্ধের প্রস্তাব অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মিশ্র বিতর্ক হয়ে অগ্রসর হয়েছে; যা একদিকে ৩০ কোটি জনগণের অনুভূতিকে আঘাত করেছে। অন্যদিকে এটি কৃষি অর্থনীতিতে পশু পালনের অপরিহার্যতা হয়ে এসেছে। গরু জবাই নিয়ে বিতর্ক ছিল যে, মৌলিক অধিকার তো জন্মগতভাবে মানুষ পায়, পশু নয়।
অনেক বিতর্কের পর সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটি একমত হয়েছেন, গরু জবাই সংবিধানে স্থান পাবে, তবে মৌলিক ও অপরিহার্য অধিকার হিসেবে নয়। একে রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশনামূলক মূলনীতি হিসেবে রাখা হয়- যার অর্থ হচ্ছে এ সংক্রান্ত নীতি তৈরির জন্য রাষ্ট্রকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তবে কোনো আদালতে এটা বলবৎ করা যাবে না। পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে এই নির্দেশনা থেকে সতর্কতার সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতির প্রশ্নটি বের করে দেয়া হয়। এমনকি গরু জবাই নিষিদ্ধের বিষয়টি রাজ্যের জন্য স্পষ্টভাবে প্রয়োজনীয় হিসেবেও রাখা হয়নি। বিপরীতে আর্টিকল ৪৮-এর আওতায় গরুর চাষাবাদ, উন্নত জাত উদ্ভাবন, জবাই নিষিদ্ধ ইত্যাদি নিয়ে আসা হয়। গরু জবাই নিষিদ্ধের বিষয়ে খসড়া সংবিধান তৈরি কমিটির ছাড় ও অস্পষ্টতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠে সাংবিধানিক পরিষদে। পরিষদের মুসলিম সদস্য জেড এইচ লারি বিবৃতি দেন, তার সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের ইচ্ছার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না; কিন্তু তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করার দাবি জানান, যাতে করে গরু জবাইয়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত অবস্থান মুসলিমরা জানতে পারেন। যাই হোক গরু জবাই বিষয়ে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অবস্থান এমন বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে যার সুরাহা কমিটি করতে চায়নি। অনুচ্ছেদ ৪৮-এর আওতায় থেকে যাওয়া এ অস্পষ্টতা অনেকবার সুপ্রিমকোর্টে পুনরাবৃত্তির জন্য যায়। ১৯৫৮ সালে কয়েকটি রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ করার পর বিষয়টির মীমাংসার জন্য সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করা হয়। বাদীদের দাবি ছিল গরু জবাই নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার লংঘন করা হয়েছে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাও লংঘন করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট তাদের আবেদন ও যুক্তি বাতিল করে আইন বলবৎ রাখে। খসড়া কমিটির মতো সুপ্রিমকোর্টও অর্থনৈতিক বিবেচনা সামনে রেখে রায় দেয় এবং বিষয়টি স্পষ্ট করতে অনিচ্ছুক থেকে যায়, যেন এটি সেক্যুলারজিমের হালকা মুখোশ দুমড়ে-মুচড়ে দেবে। ফলে অর্থনীতির বাইরে অন্যান্য বিবেচনা অস্পষ্টই থেকে যায়। যে কপটতা সাংবিধানিক পরিষদের বিতর্কে চিহ্নিত হয়েছে ও অনুচ্ছেদ ৪৮-এ চূড়ান্তভাবে থেকে গেছে এবং সুপ্রিমকোর্টের ৫০ বছরের বিচারিক ইতিহাসে খোদাই হয়ে আছে সেটাই সর্বশেষ অবতার হয়ে এসেছে সাম্প্রতিক নীতিমালায়। এখন কেন্দ্রীয় সরকার নেপাল সীমান্তে পশু পাচারের ওপর সুপ্রিমকোর্টের একটি আদেশ ও ১৯৬০ সালের প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা দমন আইনের বিষয়টি সামনে এনে তা মানার আহ্বান জানাচ্ছে। যাই হোক সুপ্রিমকোর্টের আদেশে পশু জবাইয়ের বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই, এমনকি এটা পড়ার পর দেখা যায়, সেখানে পশু জবাই নিষিদ্ধের কোনো কথাই নেই। এতে কেবল খাবারের জন্য পশু জবাই নিষিদ্ধ থেকে রেহাই দেয়াই হয়নি, সেখানে জবাইখানার ডিজাইনেরও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যাতে করে জবাইয়ের আগে পশু সম্ভাব্য কোনো ধরনের অপ্রয়োজনীয় শারীরিক ও মানসিক ব্যথার শিকার না হয়। এবার আসুন, আমাদের আইনি ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নির্বাহী কোনো আদেশ বা নোটিশ সুনির্দিষ্ট পরিভাষা (টার্ম) ও মূল আইনের সীমা যেখান থেকে কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করেছে সেটা অতিক্রম করতে পারে না।
অথচ সরকারের নতুন নীতিমালা তারও বেশি ছাড়িয়ে গেছে; জবাইয়ের জন্য পশুবাজারে গবাদিপশু বিক্রি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে তারা পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা রোধের আইন লংঘন করছে বিশেষত, সুস্পষ্টভাবে এমন বিষয় নিষিদ্ধ করে যেটা আইনে অনুমোদিত। আরও বাড়িয়ে বললে, যদি সরকারের নতুন নীতি পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা রোধেই হয়, তবে সেটা কেন শুধু গরু-মহিষ ও উটে সীমাবদ্ধ? এটা সত্য প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বা কোনো অ্যাকশন কার ওপর কার্যকর হবে সেটা পছন্দ করার ক্ষেত্রে সরকার সব সময় স্বাধীন; কিন্তু নির্বাহী কোনো কাজকে অকার্যকর করার জন্য সাধারণভাবে যখন কোনো আদালতের জন্য অন্তর্ভুক্তিতা বাদ দেয়ার নিয়ম নেই, তখন বর্তমান অবস্থায় কেবল কিছু প্রাণীর বেলায় নিষ্ঠুরতা রোধবিষয়ক নিয়ম সীমাবদ্ধ করে দেয়ার যৌক্তিক ভিত্তি নেই। সর্বোপরি নতুন আইনের ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য ও ন্যায্যতা মারাত্মক সন্দেহের উদ্রেক করছে। কেউ বিস্মিত হতে পারেন, কেন কেন্দ্রীয় সরকার এমন ঠুনকো পদক্ষেপ নিতে গেল। সম্ভাব্য একমাত্র জবাব হতে পারে এই পথে যাওয়া হয়েছে গরু জবাই কার্যকরভাবে নিষিদ্ধের জন্য প্রচলিত অর্থনৈতিক ন্যায্যতা প্রতিপাদনের জন্য এবং এটা অপরিহার্য সাংবিধানিক জটিলতার দিকে ধাবিত করতে পারে। আমাদের সংবিধান মতে, কৃষি ও প্রাণী সম্পদ সংরক্ষণ রাজ্য সরকারের আওতায় পড়ে। এ কারণেই ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন গরু জবাই আইন পাস হয়েছে। এখন এমনটি হতে পারে, কেন্দ্রের আহ্বানের পর পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা রোধ ইস্যুতে কেন্দ্র ও রাজ্য ভিন্ন ভিন্ন আইন বানাতে পারে। কেন্দ্রের নীতিমালা বিচারিক পরীক্ষার মুখে পড়তে যাচ্ছে। এটা একইসঙ্গে নাগরিকদের ও আদালতের জন্য একটি সুযোগ এ বিষয়টি আবারও ভাবার, মানুষের খাবার পছন্দের বিষয়টি সংবিধান দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হবে কিনা, যে সংবিধান সবার প্রতি সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়।
দি হিন্দু থেকে অনুবাদ : সাইফুল ইসলাম
গৌতম ভাটিয়া : দিল্লিভিত্তিক আইনজীবী
Share on Google Plus

About Unknown

    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment